।। সাজিদ মাহমুদ।।
দেশ স্বাধীনের পূর্বেই ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। ৬ দফাই প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা।
স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তার নীতির লক্ষ্য ছিল কৃষি খাতকে শক্তিশালী করা, শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করা এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন।
১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকিস্তানি বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পূর্ব পাকিস্তান শাখায় রক্ষিত সব টাকা পুড়িয়ে দেয়। স্বর্ণ এবং অন্যান্য মূল্যবান রত্ন ও দলিল-দস্তাবেজ সরিয়ে ফেলে। সে সময়ে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। আমাদের সঞ্চয়-জিডিপির হার ছিল ৩ শতাংশ। আমাদের রিজার্ভ ছিল শূন্য। সেখান থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিনিমার্ণ করেন তিনি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ৩১শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। প্রফেসর নূরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের বাকি তিন সদস্য হিসেবে ছিলেন সেসময়ের বাংলাদেশের খ্যাতিমান তিন তরুণ অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান এবং মোশাররফ হোসেন।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে (১৯৭৩-১৯৭৮) গণমানুষের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সমর্থন ভিত্তিক মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নীতি কৌশল গ্রহণ করা হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকারি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল বাজেটের ৮৮ শতাংশ এবং প্রায় ১২ শতাংশ বেসরকারি খাতে। পরিকল্পনায় কৃষির ওপর নির্ভরতা স্পষ্ট এবং শিল্প উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হয়।
কৃষি খাতের গুরুত্ব স্বীকার করে সরকার জমির বৈষম্য দূর করতে, কৃষকদের জমির অধিকার নিশ্চিত করতে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্য হ্রাস করা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশে কৃষকদের অবস্থা বেশ করুণ ছিল।সে সময়ে দেশে ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল।বঙ্গবন্ধু ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ২৫ বিঘা বলতে কার্যত প্রায় সব কৃষকের খাজনা মওকুফ করে দেন।পাকিস্তান আমলের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করেন। শক্তিচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১১ হাজার থেকে ৩৬ হাজারে উন্নীত করেন। যার ফলে ১৯৭৩ সালের মধ্যে আমাদের কৃষি অবকাঠামো ঘুরে দাঁড়ায়।
তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট করেন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট গঠন করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আনবিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র করেন। বিএডিসি ও বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করেন। সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রচারে মনোনিবেশ করে।
বঙ্গবন্ধু কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে সমবায় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।এই সমবায়গুলির লক্ষ্য ছিল স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করা। সমবায়ভিত্তিক গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও দলভিত্তিক ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ রুরাল ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করলেন।
বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন এক ডলারও বিদেশী মুদ্রার মজুদ ছিল না।তিনি অর্থনীতির চাকা সচল করেছিলেন অতি অল্প সময়েই।
১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘স্মিথসোনিয়ান এগ্রিমেন্ট’ বাস্তবায়ন করে, এর ফলে সোনা থেকে ডলারে পরিবর্তন করার প্রথা তুলে নেয়া হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ৮০ ডলারের প্রতি টন গমের দাম হয়ে যায় ২৪০ ডলার। এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৩ ডলার, যা হয়ে যায় ১১ ডলার। ৮০ ডলারের প্রতি টন সারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ ডলার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে তখনো যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব থাকায় আন্তর্জাতিক সহায়তাও পাওয়া যায় না সেভাবে। এতকিছু সত্বেও ১৯৭৪ সালের মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশকে ১৯৭৫ সালে ৩০-৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র তিন বছরেই তিনি বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে টেনে ২৭১ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা কমাতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে লক্ষ্য রেখেছিলেন।
প্রয়োজনীয় সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত করতে এবং বৈষম্য কমাতে বেশ কিছু শিল্প ও সেক্টর জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, বীমা কোম্পানি এবং বড় আকারের শিল্প। শিল্প কারখানাগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালনা আরম্ভ করেন। তবে এসব কারখানার ব্যবস্থাপনা বোর্ডে ৪০ শতাংশ শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে ‘কেমন বাংলাদেশ চাই?’ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোন অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’
অত্যন্ত বৈরী এক পরিবেশে তৎকালীন অবকাঠামো ছিল খুবই নাজুক। বেশিরভাগ সড়ক, বন্দর, সেতু বিধ্বস্ত। শিল্প-কারখানাও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান পুনর্নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। তার সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধা নির্মাণে বিনিয়োগ করেন।
একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি এমন নীতির দিকে পরিচালিত করেছিল যা দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করেছিল, বৈদেশিক সাহায্যের উপর সীমিত নির্ভরতা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের সীমা পঁচিশ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি টাকায় উন্নীত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা স্বপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময় ছিলেন। যার ফলে অর্থনৈতিক নীতিগুলির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবো বলে আমরা স্বপ্ন দেখছি।
লেখক : সাজিদ মাহমুদ
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক,
ব্যবসায় অনুষদ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়