
শিশুদের প্রতি ভালোবাসা সম্ভবত আমার স্বভাবজাত, সহজাত ও জন্মগত। স্কুল জীবন-সহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যেতাম তখন ১০-১২ জন সাত-আট বছর বয়সী ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগ্নে, ভাগনি ও প্রতিবেশী শিশু বাচ্চারা সব সময় আমার আশেপাশে থাকতো। তারাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। প্রতিদিন সকালে তাদের নিয়ে বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। আর গাছ থেকে তেঁতুল, আম, পেপে পেড়ে কলাপাতায় রেখে লবণ মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খেতাম। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো শিশুরা আমাকে অনুসরণ করত। শিশুদের নিয়ে কিছু ছড়া লিখে কেউ কেউ দাদুভাই উপাধি ধারণ করে বসে থাকলেও আমার ভাগ্যে দাদুভাই বা আদুভাই এজাতীয় উপাধি জোটেনি। বয়স বাড়লেও শিশুদের প্রতি ভালোবাসা আজও আমার কমেনি।
২০০৯ সালে আমি নোয়াখালীতে কর্মরত থাকাকালে স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে বাবর, রফিক, জনি, হাসান এরকম ৭-৮ জন ৮-১০ বছর বয়সী শিশুর সাথে পরিচয় ও সখ্য হয়। ওদের সাথে আমি ছোটো ছোটো পাসে ফুটবল খেলতাম। মাঝে মাঝে তাদের চকলেট, চিপ্স খাওয়াতাম। ৫/৬ মাস এ রকম চলতে থাকে। একদিন শুনলাম মাইজদী বাজারে মেলা বসেছে। ওইদিন স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা শেষে বাবরকে নিয়ে সন্ধ্যার পরে মেলা দেখতে গেলাম। বাবরের বয়স ছিল সাত আট বছর। মেলা হতে তাকে কিছু খেলনা ও মিষ্টি জাতীয় খাবার কিনে দিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য রওনা হলাম। তার বাড়ি ছিল নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের উত্তর প্রাচীর লাগোয়া কিছুটা গলির ভেতর। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে কিছুটা রাত হয়ে গেল। বাবরকে নিয়ে গলির মুখে ঢুকতেই দেখি ২৫/৩০ জন লোকের জটলা। সবাই কী যেন বলাবলি করছে। জটলার নিকটবর্তী হতেই কয়েক জন লোক বাবরকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো “বাবরকে পাওয়া গেছে, বাবর ফিরে এসেছে।” সকলের মুখে উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম। সবাই ধমকের সুরে আমার পরিচয় জানতে চাইলো। মনে হলো আমার পরিচয় দেওয়াতে আমি গণপিটুনি হতে রক্ষা পেলাম। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একজন লোক বিষয়টি খোলাসা করল।
“গত কয়েকদিন যাবত নোয়াখালী শহর ও আশপাশে এলাকায় ’ছেলে ধরা’-র উৎপাত বেড়ে গেছে। বেশ কিছু বাচ্চা ’ছেলেধরা-রা ধরে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগে বাবর বাড়ি ফিরে না আসায় বাবরের মা-বাবা-সহ প্রতিবেশিরা ধারণা করেছে যে, “ছেলেধরা-রা বাবরকে ধরে নিয়ে গেছে।”
শেষমেষ বাবরকে নিয়ে তাদের বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছাতেই বাড়ির ভিতর থেকে নারী কন্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। “মা গেট খোলো” বলে বাবর ডাক দিতেই বাবরের মা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির গেট খুলে দিল। বাবরকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। আমার নিজেকে তখন অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। বাবরের মাকে ঘটনা খুলে বললাম। আমার গ্রামের বাড়ি নাটোর জেলায় জানতে পেরে তাকে খুশি খুশি মনে হলো। বাবরের মা জানালো তার বাবার বাড়িও নাটোর রেল স্টেশনে। আমাকে শেষমেষ নাস্তা না করে তিনি আসতেই দিলেন না। বদলিজনিত কারণে যেদিন আমি নোয়াখালী ছেড়ে রাজশাহী চলে আসবো সেদিন বাবরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেওয়ার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
২০১১/২০১২ সালে আমি পূর্ব তিমুর মিশনে কর্মরত ছিলাম। আমার কর্মস্থল ছিল রাজধানী দিলি শহর হতে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গ্লেনো শহরে। আমি যে দম্পতির বাসায় ভাড়া থাকতাম তাদের ছিল দুই ছেলে, এক মেয়ে। শিশুদের সঙ্গে মিশতে হলে তাদের মনের ও মুখের ভাষা জানা জরুরি। আমি অল্প দিনের মধ্যেই পূর্ব তিমুরের ‘তেতুম ভাষা’ রপ্ত করে ফেলি। বাড়িওয়ালার ছেলে-মেয়েসহ আশপাশের ৫/৬ টা শিশু প্রতিদিন আমার বাসায় আসতো, আমার সাথে গল্প করতো, কোলেপিঠে উঠতো, খেলতো, মজা করতো, আমার বিছানায় বসে, শুয়ে ল্যাপটপে সিনেমা দেখতো। আমিও তাদের বাসায় যেতাম। তাদের বাসার বসার রুম থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত ছিল আমার বিচরণ। এভাবে ওই শিশুদের সাথে প্রায় দেড় বছর কাটানোর পর এলো আমার বিদায়ের পালা। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের এক দ্বীপ দেশের অবুঝ শিশুদের সাথে আমার মতো কোনো ভীনদেশী মিশতে পেরেছে কি না, এরকম ভালোবাসতে পেরেছে কি না তা আমার জানা নেই। বিদায়ের দিন সকাল থেকে আমার মনটা খারাপ ছিল। ভাবছিলাম এই দেশে তো আর কোনোদিন আসা হবে না, এই অবুঝ শিশুদের সাথে জীবনে কোনোদিন দেখা হবে না। এই শিশুরা আর কখনও বলবে না, “মালয় দিয়াক”(বিদেশি তুমি খুব ভালো), ” কুলেগা পুলিসিয়া হালিমার ফুতবলা” ( পুলিশ বন্ধু, চলো ফুটবল খেলি)। সব শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বিদায় নেওয়ার সময় আমি অঝোরে কেঁদেছি। তাদের চোখের কোনেও যে জল এসেছিল। পথিমধ্যে তাদের মুখচ্ছবি বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। একটা কথাই বলেছি, ভালো থেকো নিনো, নিনা, আলিউ, ম্যানুয়েল, রবিন, জিকো নামের অবুঝ মানব শিশুগুলো।
ঠাকুরগাঁও-এ কর্মরত থাকাকালে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস হতে আমি হাজীপাড়ায় একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। আমরা তিন তলায় থাকতাম। আমাদের বাসার দক্ষিণ পাশে একেবারেই লাগোয়া আরেকটি বিল্ডিং ছিল। ওই বিল্ডিং এর তিন তলায় একটি পরিবার বসবাস করতো। ওই দম্পতির ছিল তিন সন্তান; অরিন, আলিম ও কামাল। ওদের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা থানা এলাকায়। কামাল সবার ছোটো। বয়স দুই-আড়াই বছর। আমাদের শোবার ঘরের সাথে প্রায় লাগানো কামাল ও তার বাবা-মায়ের শোবার ঘর। প্রতিদিন সকালে জানালা দিয়ে কামাল আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো। মাঝে মধ্যে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। ২/৩ ঘন্টা ধরে আমার ছেলে মেয়েদের সাথে খেলাধুলা করতো। ইফতার পার্টি, জন্মদিন-সহ সব অনুষ্ঠানে আমরা একে অপরের বাসায় যেতাম। প্রতিদিন সকালে কামালের আবদার ছিল, আংকেল আজ চকলেট নিয়ে আসবেন, আজ কেক নিয়ে আসবেন ইত্যাদি। আমি বা আমার বউ, ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিনই তাকে কিছু না কিছু কিনে দিতাম, জানালার ভিতর দিয়ে পিঠা, পায়েস, তরকারি আদান-প্রদান করতাম। প্রতিদিন সে জানালা দিয়ে আমাদের সাথে সকাল থেকে রাতে ঘুমানো অবধি কথা বলতো। কোনো সময় জানালার পর্দা নামিয়ে দিলে “শখ আপু, ববিতা আপু, সাদী ভাইয়া, আন্টি জানালা খোলো, জানালা খোলো” বলে সে হাউমাউ করে কাঁদতো। সে এক প্রকার আমাদের সন্তানের মতোই হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ শুনলাম, কামালেরা বাসা ছেড়ে দিয়ে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। শুনেই বুকের ভিতর ধক করে উঠলো।
কামালেরা বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন দুই পরিবারেরই মন খারাপ ছিল। আমার গ্রামের বাড়ি হতে কামালদের বাড়ি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। আর কোনো দিন কামালের সঙ্গে দেখা হবে না এই ভেবে বুকটা হু হু করে উঠেছিল।
বিপ্লব। একজন মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে। বয়স ১৫/১৬ বছর। বাড়ি ভূল্লী থানার পিছনে। পাগলকে পাগল বলতে নেই। আমি তাকে আদর করে বিপ্লব পাগলা বলেই ডাকি। আমি ভূল্লী থানার ভিতরেই একটা রুমে রাত্রী যাপন করি। প্রতিদিন সকালে সে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিত। সকাল-বিকালে তার সাথেই আমি চা-বিস্কুট খেতাম। অবসর সময়ে তাকে নিয়ে আমি মোটরসাইকেলে বা গাড়িতে করে থানা এলাকায় ঘুরে বেড়াতাম। আমার বদলির কথা শুনে তার কান্না দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। তার সাথে হয়তো আর কখনও দেখা হবে না।
কিছু সময়ের জন্য আমরা মায়ায় পড়ি, মোহাবিষ্ট হই। আবার ভুলে যাই, আবারও নতুন কারোর মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ি।
পুলিশে চাকরি করতে এসে লাশ টেনেছি প্রায় শ’তিনেক। বহু মানুষের বুকভাঙা কান্না শুনেছি। কিন্তু আমি কাঁদিনি। বুকটা আমার বোধহয় পাথর হয়ে গেছে। ধারণা ছিল, আর বোধহয় কোনোদিন কাঁদতে পারবো না। কিন্তু আজ বিপ্লবকে বিদায় দিতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না। আমি কেন-জানি শিশুদের মায়া জালে জড়িয়ে যাই। হয়তো আগামীকাল সকালে বিপ্লব আমার স্বপ্নের মধ্যে এসে বলবে, “আংকেল, “উঠ্, চল্, চা খা, নাস্তা কর্।” ঘুম ভেঙে গেলে যখন জানালার পাশে তাকে দেখবো না, তখন বুকটা ভেঙে যাবে। তার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে বারবার।
ভালো থেকো বিপ্লব পাগলা৷ সকল বিপ্লবরা ভালো থাকুক এই দোয়া করি।
—————————————-
৬ ডিসেম্বর ২০২৫
ঠাকুরগাঁও।